আলোচক ড: সৈয়দ এরশাদ আহমাদ আল বুখারী, প্রতিষ্ঠা আল কুরআন একাডেমী আমেরিকা ও ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার

কুরআন ও হাদীস -এর ভাষা যেহেতু আরবী তাই ফার্সী ‘শাব’ শব্দটি কুরআন শরীফ ও হাদীস শরীফ-এ না থাকাটাই স্বাভাবিক। মনে রাখতে হবে যে, কুরআনের ভাষায় ‘শাবে বারাতকে’ ‘লাইলাতুম মুবারাকাহ বা বরকতময় রজনী’ এবং হাদীসের ভাষায় শাবে বারাতকে ‘লাইলাতুন নিছফি মিন শা’বান’ বা শা’বানের চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাত’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তাই কেউ যদি কুরয়ানে শাবে বারাত খুজে তাহলে সেটা অবশ্যই বোকামি হবে যেমনটা ক্বুরয়ানে নামায রোযা খুজলে হবে।
.
আল্লাহ ইরশাদ করেন- অর্থ: “নিশ্চয়ই আমি বরকতময় রজনীতে কুরআন নাযিল করেছি। আর আমিই ভয় প্রদর্শনকারী। উক্ত রাত্রিতে আমার পক্ষ থেকে সমস্ত প্রজ্ঞাময় কাজ গুলো ফায়সালা করা হয়। আর নিশ্চয়ই আমিই প্রেরণকারী।” (সূরা দুখান-৩, ৪, ৫)।
.
এ আয়াতের প্রসঙ্গে রাঈসুল মুফাসসিরীন বিশিষ্ট সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাঃ (যার জন্য স্বয়ং রাসুলুল্লাহ ﷺ দুয়া করেছেন যে, হে আল্লাহ তুমি আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাসকে কুরয়ানের ব্যাখ্যা করার জ্ঞান দান করুন। (তিরমিযী শরীফ) স্বীয় তাফসীরে উল্লেখ করেন, “মহান আল্লাহ পাক লাইলাতুম মুবারাকাহ বলতে শা’বান মাসের মধ্য রাত বা শাবে বারাতকে বুঝিয়েছেন। আল্লাহ পাক এ রাতে প্রজ্ঞাময় বিষয়গুলোর ফায়সালা করে থাকেন।”(ছফওয়াতুত তাফসীর, তাফসীরে খাযীন ৪র্থ খন্ডঃ ১১২ পৃষ্ঠা, তাফসীরে ইবনে আব্বাস, তাফসীরে মাযহারী ৮ম খন্ডঃ ৩৬৮ পৃষ্ঠা, তাফসীরে মাযহারী ১০ম খন্ড, তাফসীরে খাযিন, বাগবী, কুরতুবী, কবীর, রুহুল বয়ান, আবী সাউদ, বাইযাবী, দূররে মানছূর, জালালাইন ইত্যাদি)
তবে অন্যান্য মুফাসসিরিন এই আয়াতের প্রেক্ষাপট হিসেবে শাবে ক্বাদরকেও আখ্যায়িত করেছেন। কিন্তু নিচে বর্ণিত কিছু সহিহ ও হাসান হাদিস দেয়া হল, যার বিষয়ে হক্কানী আলেমদের কোনো মতবিরোধ নেই আলহামদুলিল্লাহ।
.
এ রাতের সুন্নাহ হচ্ছে নিজের আত্মীয় স্বজনদের কবর যিয়ারত করা। সহিহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে-
ﻋﻦ ﺍﻡ ﺍﻟﻤﺆﻣﻨﻴﻦ ﺣﻀﺮﺕ ﻋﺎﺋﺸﺔ ﻋﻠﻴﻬﺎ ﺍﻟﺴﻼﻡ ﻗﺎﻟﺖ ﻓﻘﺪﺕ ﺭﺳﻮﻝ ﺍﻟﻠﻪ ﺻﻠﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻪ ﻭﺳﻠﻢ ﻟﻴﻠﺔ ﻓﺎﺫﺍ ﻫﻮ ﺑﺎﻟﺒﻘﻴﻊ ﻓﻘﺎﻝ ﺍﻛﻨﺖ ﺗﺨﺎﻓﻴﻦ ﺍﻥ ﻳﺤﻴﻒ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻚ ﻭﺭﺳﻮﻟﻪ ﻗﻠﺖ ﻳﺎ ﺭﺳﻮﻝ ﺍﻟﻠﻪ ﺻﻠﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻪ ﻭﺳﻠﻢ ﺍﻧﻰ ﻇﻨﻨﺖ ﺍﻧﻚ ﺍﺗﻴﺖ ﺑﻌﺾ ﻧﺴﺎﺋﻚ ﻓﻘﺎﻝ ﺍﻥ ﺍﻟﻠﻪ ﺗﻌﺎﻟﻰ ﻳﻨﺰﻝ ﻟﻴﻠﺔ ﺍﻟﻨﺼﻒ ﻣﻦ ﺷﻌﺒﺎﻥ ﺍﻟﻰ ﺍﻟﺴﻤﺎﺀ ﺍﻟﺪﻧﻴﺎ ﻓﻴﻐﻔﺮ ﻻﻛﺜﺮ ﻣﻦ ﻋﺪﺩ ﺷﻌﺮ ﻏﻨﻢ ﻛﻠﺐ
অর্থ: উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়িশা ছিদ্দীক্বা রাঃ থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ ﷺ সাথে কোন এক রাত্রিতে রাত্রিযাপন করছিলাম। এক সময় উনাকে বিছানায় না পেয়ে আমি মনে করলাম যে, তিনি হয়তো অন্য বিবিগনের হুজরা শরীফে তাশরীফ নিয়েছেন। অতঃপর আমি তালাশ করে উনাকে জান্নাতুল বাক্বীতে (মদিনার কবরস্থান) পেলাম। সেখানে তিনি উম্মতের জন্য আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করছেন। এ অবস্থা দেখে আমি স্বীয় হুজরা শরীফে ফিরে আসলে তিনিও ফিরে এসে আমাকে বললেন, আপনি কি মনে করেছেন, আল্লাহ আপনার সাথে আমানতের খিয়ানত করেছেন! আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ ﷺ ! আমি ধারণা করেছিলাম যে, আপনি হয়তো অপর কোন হুজরা শরীফে তাশরীফ নিয়েছেন। অতঃপর রাসুলুল্লাহ ﷺ বললেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ মধ্য শা’বানের (অর্থাৎ ১৪ তারিখ দিবাগত রাত) রাত্রিতে পৃথিবীর আকাশে জিবরীল আঃ ও ফেরেশতাদের অবতরণ করান, ও রহমতে খাছ নাযিল করেন। অতঃপর তিনি বনী কালবের (সে সময়ের সবচেয়ে বড় মেষপালন গোত্র,যাদের সহস্রাধিক মেষ ছিলো) মেষের গায়ে যতো পশম রয়েছে তার চেয়ে অধিক সংখ্যক বান্দাকে ক্ষমা করে থাকেন।” ( ইমাম আহমাদ তার মুসনাদে বর্ণনা করেন (৬/২৩৮), তিরমিযি তার সুনানে (২/১২১,১২২), ইবনে মাজাহ, রযীন, মিশকাত )।
.
আহলে হাদিসদের মান্যবর ইবনে তাইমিয়া ফাওজুল ক্বাদীর নামক বইয়ের ২য় খণ্ড, পৃ৩১৭ এ হাদিসটি উল্লেখ করে। আহলে হাদিসদের শায়খ নাসিরুদ্দিন আলবানী আস-সিলসিলাহ আস-সাহীহাহ (৩/১৩৫) এ এই হাদিসকে সহীহ বলেছে। আল-মুনযিরী তাঁর আত-তারগীব ওয়াত তারহীবে (২/১৩২) বলেন “সহিহ হাদিস”। বিখ্যাত হাদীস গবেষক হাফেয নুরুদ্দীন হাইসামী বলেন হাদিসটি সহিহ (৮০৭ হিঃ),মাযমাউয যাওয়ায়েদ ৮/৬৫। ইবনে রজব হাম্বলী বলেন হাদিসটি সহিহ ৭৯৫ হিঃ, লাতায়েফুল মাআরিফ পৃঃ ১৫১ ইমাম যুরকানী বলেন হাদিসটি সহিহ (১১২২ হিঃ), শরহে মাওয়াহিব ১০/৫৬১। এছাড়াও অন্য কোনা মুহাদ্দিসই এটিকে মাওযু বা জাল বলে আখ্যায়িত করেননি।
.
এ রাত হচ্ছে উম্মতের গুনাহ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার রাত। এ বিষয়ে রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ মধ্য শা’বানের (অর্থাৎ ১৪ দিবাগত রাতে) রাত্রিতে ঘোষনা করেন যে, উনার সমস্ত মাখলুককে ক্ষমা করে দিবেন। শুধু মুশরিক ও হিংসা-বিদ্বেষকারী ব্যতীত।”
( আহমদ, মিশকাত শরীফ, ইমাম ইবনে মাজাহ তার সুনানে (১/৪৫৫, হাদীস নং ১৩৯০), এবং তাবরানী তার মু’জামুল কাবীর (২০/১০৭,১০৮) গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন।
.
শাবে বারাতের রাতে সারারাত ইবাদত করে পরের দিন রোযা রাখার গুরুত্ব অনেক। স্বয়ং রাসুলুল্লাহ ﷺ এ আদেশ দিয়েছেন। হযরত আলী রাঃ বর্ননা করেন, রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেন, যখন অর্ধ শা’বানের রাত তথা শাবে বারাত উপস্থিত হবে তখন তোমরা উক্ত রাতে সজাগ থেকে ইবাদত-বন্দেগী করবে এবং দিনের বেলায় রোযা রাখবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ পাক উক্ত রাতে পৃথিবীর আকাশে জিবরীল আঃ ও ফেরেশতাদের নাযিল করেন। অতঃপর ঘোষণা করতে থাকেন, কোন ক্ষমা প্রার্থনাকারী আছো কি? আমি ক্ষমা করে দিব। কোন রিযিক প্রার্থনাকারী আছো কি? আমি তাকে রিযিক দান করব। কোন মুছিবতগ্রস্ত আছো কি? আমি তার মুছিবত দূর করে দিবো। এভাবে সুবহে ছাদিক পর্যন্ত ঘোষণা করতে থাকেন”। (সুনান-ই-ইবনে মাজাহ, খন্ড-০২, পৃষ্ঠা-১৬০, হাদিস-১৩৮৮ এবং মিশকাত শরিফ-১১৫)
.
রাসুলুল্লাহ ﷺ শাবে বারাতের মাসে অনেক রোযা রাখতেন। এমনোও হত যে তিঁনি পুরো শাবান মাসব্যাপী রোযা রাখতেন, আল্লাহু আকবার। হযরত আয়েশা সিদ্দিকা রাঃ হতে বর্ণিত,
مَا رَأَيْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ اسْتَكْمَلَ صِيَامَ شَهْرٍ إِلَّا رَمَضَانَ، وَمَا رَأَيْتُهُ أَكْثَرَ صِيَامًا مِنْهُ فِي شَعْبَانَ
আমি রাসুলুল্লাহ ﷺ কে রমজান মাসের পর শাবান ব্যতীত অন্য কোন মাসে এত রোজা রাখতে দেখিনি। (সহিহ বুখারী, কিতাবুস সাওম, হাদীস নং-১৯৬৯/১৮৬৮, সহীহ মুসলিম, কিতাবুস সিয়াম, হাদীস নং-১১৫৭,সুনানে আবু দাউদ, কিতাবুস সাওম, হাদীস নং-২৪৩৪, সুনানু ইবনে মাজাহ, কিতাবুস সিয়াম, হাদীস নং-১৭১০, মুয়াত্তা এ মালিক- ৬৮৮/১০৯৮, সহীহ ইবনে হাববান-৩৬৪৮, মুসনাদে আহমদ-২৪৮০১, নাসাঈ আস সুনানুল কুবরা-২৬৭২, বায়হাক্বী আস সুনানুস সগীর-১৪৫৭, সুনানুল কুবরা-৭৭৮৪,৭৮২৫)
.
অপর বর্ননায় এসেছে,
لَمْ يَكُنِ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَصُومُ شَهْرًا أَكْثَرَ مِنْ شَعْبَانَ، فَإِنَّهُ كَانَ يَصُومُ شَعْبَانَ كُلَّه
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম ﷺ শাবান মাসের চেয়ে অধিক রোজা অন্য কোন মাসে রাখতেননা, এমনকি তিনি পুরো শাবান মাস রোজা রাখতেন। (সহিহ বুখারী, হাদীস নং-১৯৭০, সহীহ মুসলিম, কিতাবুস সিয়াম, হাদীস নং-১১৫৭, নাসাঈ আস সুনানুল কুবরা-২১৭৯, নাসাঈ আস সুনানুল কুবরা-২৫০০, সহীহ ইবনে হিববান-৩৬৩৭)
.
এদিনেই আমাদের আমলনামা আল্লাহর দরবারে পেশ করা হয়, এদিনেই আগামী এক বছরে যারা ইন্তেকাল করবে তাদের নাম ফেরেশতাদের জানিয়ে দেয়া হয়।
আয়েশা সিদ্দিকা রাঃ হতে বর্ণিত
ﻋَﻦْ ﻋَﺎﺋِﺸَﺔَ ﻋَﻦِ ﺍﻟﻨَّﺒِﻲِّ ﺻَﻠَّﻰ ﺍﻟﻠَّﻪُ ﻋَﻠَﻴْﻪِ ﻭَﺳَﻠَّﻢَ ﻗَﺎﻝَ : ﻫَﻞ ﺗﺪﺭﻳﻦ ﻣَﺎ ﻫَﺬِﻩ ﺍﻟﻠَّﻴْﻞ؟ ﻳَﻌْﻨِﻲ ﻟَﻴْﻠَﺔَ ﺍﻟﻨِّﺼْﻒِ ﻣِﻦْ ﺷَﻌْﺒَﺎﻥَ ﻗَﺎﻟَﺖْ : ﻣَﺎ ﻓِﻴﻬَﺎ ﻳَﺎ ﺭَﺳُﻮﻝَ ﺍﻟﻠَّﻪِ ﻓَﻘَﺎﻝَ : ﻓِﻴﻬَﺎ ﺃَﻥْ ﻳُﻜْﺘَﺐَ ﻛﻞُّ ﻣَﻮْﻟُﻮﺩٍ ﻣِﻦْ ﺑَﻨِﻲ ﺁﺩَﻡَ ﻓِﻲ ﻫَﺬِﻩِ ﺍﻟﺴَّﻨَﺔِ ﻭَﻓِﻴﻬَﺎ ﺃَﻥْ ﻳُﻜْﺘَﺐَ ﻛُﻞُّ ﻫَﺎﻟِﻚٍ ﻣِﻦْ ﺑَﻨِﻲ ﺁﺩَﻡَ ﻓِﻲ ﻫَﺬِﻩِ ﺍﻟﺴَّﻨَﺔِ ﻭَﻓِﻴﻬَﺎ ﺗُﺮْﻓَﻊُ ﺃَﻋْﻤَﺎﻟُﻬُﻢْ ﻭَﻓِﻴﻬَﺎ ﺗَﻨْﺰِﻝُ ﺃَﺭْﺯَﺍﻗُﻬُﻢْ ﻓَﻘَﺎﻟَﺖْ : ﻳَﺎ ﺭَﺳُﻮﻝَ ﺍﻟﻠَّﻪِ ﻣَﺎ ﻣِﻦْ ﺃَﺣَﺪٍ ﻳَﺪْﺧُﻞُ ﺍﻟْﺠَﻨَّﺔَ ﺇِﻟَّﺎ ﺑِﺮَﺣْﻤَﺔِ ﺍﻟﻠَّﻪِ ﺗَﻌَﺎﻟَﻰ؟ ﻓَﻘَﺎﻝَ : ﻣَﺎ ﻣِﻦْ ﺃﺣﺪ ﻳﺪْﺧﻞ ﺍﻟْﺠﻨَّﺔ ﺇِﻟَّﺎ ﺑﺮﺣﻤﺔ ﺍﻟﻠﻪ ﺗَﻌَﺎﻟَﻰ . ﺛَﻠَﺎﺛًﺎ . ﻗُﻠْﺖُ : ﻭَﻟَﺎ ﺃَﻧْﺖَ ﻳَﺎ ﺭَﺳُﻮﻝَ ﺍﻟﻠَّﻪِ؟ ﻓَﻮَﺿَﻊَ ﻳَﺪَﻩُ ﻋَﻠَﻰ ﻫَﺎﻣَﺘِﻪِ ﻓَﻘَﺎﻝَ : ﻭَﻟَﺎ ﺃَﻧَﺎ ﺇِﻟَّﺎ ﺃَﻥْ ﻳَﺘَﻐَﻤَّﺪَﻧِﻲَ ﺍﻟﻠَّﻪُ ﺑِﺮَﺣْﻤَﺘِﻪِ . ﻳَﻘُﻮﻟُﻬَﺎ ﺛَﻠَﺎﺙَ ﻣَﺮَّﺍﺕٍ
রাসূলে কারিম স্বাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ﷺ ইরশাদ করেন, তুমি কি এ রাত তথা শাবানের ১৫তম রজনী সম্পর্কে কিছু জান? তিনি আরজ করলেন এ রাতে কি রয়েছে? রাসূলে কারিম স্বাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ﷺ ইরশাদ করেন, এ রাতে যে সকল বনী আদম জন্মগ্রহন করবে তাদের নাম চূড়ান্ত করা হবে আর যে সকল বনী আদম মৃত্যুবরন করবে তাদের নামও লিপিবদ্ধ করা হবে। এ রাতে তাদের পুরো বছরের আমলসমূহ রাব্বুল আলামীনের দরবারে পেশ করা হবে আর এ রাতে তাদের রিযিক/জীবিকা নির্ধারণ করা হবে। অতপর তিনি এরশাদ করলেন, নিশ্চই আল্লাহর অনুগ্রহ ব্যতীত কেও জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবেনা; তিনি এ বাক্য তিনবার বলেন। অতপর উম্মুল মু’মিনিন আরজ করলেন, আপনিও হে আল্লাহর রাসূল? রাসূলে কারিম ﷺ স্বীয় হাত মুবারক মাথা মুবারকের উপর রেখে ইরশাদ করেন, নিশ্চই আমি আল্লাহর রহমতের মাধ্যমে জান্নাতে প্রবেশ করবো। এ বাক্য তিনি তিনবার ইরশাদ করেন। (বায়হাক্বী শরীফ-দাওয়াতে কবীর; হাদীস ৫৩০; মিশকাত শরীফ; ১১৫ পৃ, হাদীস ১৩০৫)।
ওসামা বিন যায়দ রাঃ বলেন: হে আল্লাহর রাসুল আমি দেখেছি, যেভাবে আপনি শাবান মাসে রোযা রাখেন সেভাবে অন্য কোন মাসে (রোযা) রাখেন না? তিনি ইরশাদ করলেন: রজব ও রমযান এর মধ্যবর্তী এ মাস রয়েছে। লোকেরা এটা থেকে উদসীন। এ মাসে মানুষের আমল সমূহ আল্লাহ তাআলার কাছে নেয়া হয় আর আমি এটা পছন্দ করি যে, আমার আমল এ অবস্থাতে উঠানো হোক যখন আমি রোযা অবস্থায় থাকি। (সুনানে নাসায়ী, ৩৮৭ পৃষ্ঠা, হাদীস নং- ২৩৫৪)।
হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রাদ্বিয়াল্লাহ আনহা) হতে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ (ﷺ) কে প্রশ্ন করা হলো আপনার কাছে শাবান মাসের রোজা এতো পছন্দনীয় কেনো? রাসুলুল্লাহ স্বাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ﷺ এরশাদ করেন আল্লাহ এই মাসে এই বছরে মারা যাওয়া ব্যক্তির রুহ এর নাম লিখে থাকেন এবং আমি পছন্দ করি যে, আমি যেন ওফাতের সময় রোজা অবস্থায় থাকি। (মুসনাদে আবু ইয়ালা, খন্ড-০৪, হাদিস- ৪৮৯০)।
.
শাবান মাসকে রাসুলুল্লাহ ﷺ নিজের মাস বলে ঘোষনা করেছেন। হাদীস বর্ণিত আছে-
رَجَبُ شَهْرُ اللَّهِ وَشَعْبَانُ شَهْرِي وَرَمَضَانُ شَهْرُ أُمَّتِي
রাসুলুল্লাহ স্বাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ﷺ বলেনঃ রজব আল্লাহর মাস,শাবান আমার মাস আর রমজান আমার উম্মতের মাস। (ফিরদাউসুল আখবার, যাহাভী তারিখুল ইসলাম-২৬১, শওকানী ফাওআয়িদুল মাজমুয়া’ত-২২১, কানযুল উম্মাল-৩৫১৬৪, সাখাভী আল মাকাসিদুল হাসানাহ-৫১০, নুজহাতুল মাজালিস ওয়া মুনতাখাবুন নাফাইস, বাব,ফাদলু শ’বান ওয়া ফাদলু সালাতুত তাসবীহ, ১:১৪৬/১:১৬১)
.
এ রাত দু’য়া কবুল হওয়ার রাত। ঈমাম শাফেয়ী রাঃ বলেনঃ আমাদের কাছে পৌঁছেছে যে ৫টি রাতের দোয়া আল্লাহ কবুল করেন তা হলঃ ১. জুমু’আর রাত। ২. ঈদ উল আদ্বহার রাত। ৩. ঈদ উল ফিতরের রাত। ৪. রজব মাসের ১ম রাত। ৫. ১৫-ই শাবান রাত আর আমি পছন্দ করি এগুলোর উপর আমল করা। (কিতাবুল উম্ম, ঈমাম শাফিঈ (রহঃ)- ১/২৬৪, ইবনে রজব লাতায়িফুল মা’আরিফ ১:১৩৭)। একই কথা ইমাম গাজ্জালী রাঃ তার মুকাশাফাতুল ক্বুলুবে উল্লেখ করেছেন।
.
ইবনে তাইমিয়া শাবে বারাত সম্পর্কে বলেছে, “শা’বানের পনের তারিখ রাতে একাকী যদি নামায আদায় করে অথবা বিশেষ জামাতে নামায আদায় করে, যেমন একদল মুসলিম করে থাকে, তবে এটি উত্তম। গ্রন্থ সূত্রঃ মাজমুয়াতুল ফাতাওয়া, খ.২৩, পৃ.১৩১-১৩২।
.
সিহাহ সিত্তারই দুটি কিতাব – তিরমিযী শরীফ ও সুনানে ইবনে মাজাহতে শুধু যে শাবে বারাত এর ফজীলত সম্পর্কিত হাদীস বর্ণিত আছে তা নয়, বরং ইমাম তিরমিযী (রহঃ) তাঁর তিরমিযী শরীফে এবং ইমাম নাসাঈ (রহঃ) তাঁর সুনানে শাবানের ফজীলত নিয়ে আলাদা বাব বা অধ্যায়ই লিখেছেন। এর মাধ্যমেই আমরা ইমামদ্বয়ের কাছে শাবানের চৌদ্দ দিবাগত রাতের কি পরিমাণ গুরুত্ব ছিল, তা কিছুটা আঁচ করতে পারি।
.
সিহাহ সিত্তার বাইরেও অনেক ইমামগণ তাদের জগৎবিখ্যাত বড় বড় হাদীসগ্রন্থে শাবে বারাত ও তার ফজীলত নিয়ে হাদীস বর্ণনা করেছেন। যেমনঃ
১। ইমাম তাবরানী রচিত “আল কাবীর” এবং “আল আওসাত”
২। ইমাম ইবনে হিব্বান রচিত “সহীহ ইবনে হিব্বান”
৩। ইমাম বায়হাকী রচিত “শুআবুল ঈমান”
৪। হাফেয আবু নুআইম রচিত “হিলয়া”
৫। হাফেয হায়ছামী রচিত “মাজমাউয যাওয়ায়েদ”
৬। ইমাম বাযযার তাঁর “মুসনাদ” এ
৭। হাফিয যকী উদ্দীন আল মুনযিরী রচিত “আততারগীব ওয়াত-তারহীব”
৮। ইমাম আহমদ তাঁর “মুসনাদ” এ
৯। মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা
১০। হাফেয আব্দুর রাজ্জাক এর “মুসান্নাফ” এ আমরা শবে বরাতের ফজীলত সম্পর্কিত বহু হাদীস দেখতে পাই।
.
মুসলিম বিশ্বের মহা মনীষীগণ কুরআন করীমের নির্ভরযোগ্য তাফসীরগ্রন্থ, হাদীছের ব্যাখ্যাগ্রন্থ এবং প্রায় বড় বড় আলেম নিজেদের রচিত কিতাবাদীতে কেউ সংক্ষেপিত আকারে কেউ বা সবিস্তারে শাবে বারাতের ফজীলত ও গুরুত্ব লিপিবদ্ধ করে গেছেন। যেমনঃ
ক) পাঁচশত হিজরীর ইমাম গাযযালী (রহঃ) রচিত এহইয়াউ উলুমিদ্দীন। খ) ৬০০ হিজরীর প্রারম্ভে শায়খ আব্দুল ক্বাদের জ্বীলানী (রহঃ) এর গুনিয়াতুত তালেবীন। গ) ৭০০ হিজরীর ইমাম মুহাম্মদ আল জাযারী (রহঃ) এর আদদোয়াউ ওয়াস সালাত ফী যওইল কুরআন ওয়াস সুন্নাহ। ঘ) ৭০০ হিজরীর ইমাম আবু জাকারিয়া ইবনে ইয়াহইয়া ইবনে শারফুদ্দীন নববী (রহঃ) এর রিয়াজুস সালেহীন। ঙ) এগারশত হিজরীর শায়েখ আব্দুল হক্ব মুহাদ্দিসে দেহলভী (রহঃ) এর মা ছাবাতা বিস সুন্নাহ।
.
আল্লাহ্ তা’আলা এ রাতে অগণিত গুনাহগার বান্দাকে ক্ষমা করে দেন, তবে কয়েক শ্রেণীর লোক রয়েছে যারা ক্ষমার অযোগ্য রয়ে যায়। তারা হল: মুশরিক, যাদুকর, ব্যভিচারী, সুদখোর, হিংসা-বিদ্বেষকারী, পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তান, আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী।
তবে তারা উপরিউক্ত কাজ আর করবে না বলে আল্লাহর দরবারে খালেস অন্তরে তওবা করলে তারাও মাফ পেতে পারে। কেননা আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল।
.
এ রাতের আমলসমুহ হলো নফল নামায পড়া, ক্বুরয়ান পাঠ করা, দরুদ শরিফ পড়া, হামদ নাত পাঠ, ইয়াতিম মিসকিনদের সাহায্য করা ইত্যাদি। এছাড়াও আপনি অন্যান্য সাওয়াবের কাজও করতে পারেন।
.
এ রাতের বর্জনীয় কাজের মধ্যে আতশবাজি করা, ইবাদত না করে আড্ডাবাজিতে এই গুরুত্বপূর্ণ রাত অতিবাহিত করা সহ যাবতীয় ক্বুরয়ান ও সুন্নাহ বিরোধী কাজ থেকে নিজেকে দূরে রাখা উচিৎ।
.
তাই শাবে বারাত রাসুলুল্লাহ স্বাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ﷺ, সাহাবী, তাবেয়ী এবং সালফে সালেহীন দ্বারা উদযাপিত, আলহামদুলিল্লাহ্।
আল্লাহ আমাদের এ পবিত্র রাতে ইবাদত বন্দেগী করার ও ইসলামবিরোধীদের অপপ্রচার থেকে বেঁচে থাকার তাওফিক দান করুন।